শ্রাবণের ধারার মতো

বৈশাখে নয়, শ্রাবণেই তাঁকে পাই নিবিড় করে। বৈশাখের নিদাঘে আমরা তাঁর কাছে ছায়া খুজি, আর শ্রাবণে খুঁজি মায়া। তিনি রবীন্দ্রনাথ পঁচিশে বৈশাখে উদয় দিগন্তের শঙ্খের ধ্বনিতে,আমের বোলের তীব্র গন্ধে,উদ্ধত শাখার কৃষ্ণচূড়ার গরিমায় যেন অনেক দূর থেকে দেখতে হয় তাঁকে। কিন্তু শ্রাবণ বেলায় তিনি একেবারে হৃদয় জুড়ে বসেন। শ্রাবণমেঘের অঞ্চলছায়া বিছিয়ে, বেলাযুথির মালা গেঁথে, সিক্ত চাঁপার কলির অঞ্জলিবদ্ধ প্রণতিতে আমরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করি। তারপর এক বাইশে শ্রাবণে, গোপন চরণ ফেলে, সবার দিঠি এড়িয়ে, একলা পথিকের মতো তিনি আসেন কবির জন্য শ্রাবন, শ্রাবনের জন্য কবি।

শ্রাবন কবির প্রয়াণ মাস। তবু বাইশে শ্রাবনে আমরা শোক করি না, করি তাঁর মৃত্যু উদযাপন করি মৃত্যুযাপন। দাঁড়াই সেই অ-শোকতরুর নিচে—যার শিকড়ে লেগে থাকে স্মৃতির ঝুরঝুরে মাটি, যার কাণ্ডে ঝড়কে ঠেকানোর দৃঢ়তা, যার শাখা প্রশাখায় নিশ্চিন্ত আশ্রয়, হয়তো সে শাখায় সুবাস ছড়ানো ফুল ফোটে না, সুস্বাদু ফল ধরে না একেবারে। তবু সেই শাখাকেই জাগিয়ে দেয় বাদল বাতাস। আকাশ থেকে ‘শ্রাবনের ধারার মতো তোমারি সুরটি আমার মুখের ‘পরে, বুকের ‘পরে…’ ঝরতে থাকে’সেই সুরে বুঝি মিশে থাকে বিস্ময়, বিরহ, বিচ্ছেদ, বিদায়ব্যথা, বিষাদ, বিদ্রোহও। 

বিস্ময়ে তাই জাগে…

মনে পড়ে প্রথম যে বাইশে শ্রাবণে মায়ের সঙ্গে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি গিয়েছিলাম। সে ছিল আমার অবোধবেলা। দেখেছিলাম প্রয়াণকক্ষে সাদা আলপনার মাঝে ঝকঝকে পেতলের কলসীতে রাখা গোছা গোছা রজনীগন্ধা, পাথরের রেকাবিতে রাখা চাঁপাফুল, সাদাচাদর বিছানো খাটে বেলফুলের মেলায় সাজানো রবিঠাকুরের ছবি, সামনে রাখা ধূপের জালিকাটা ধোঁয়ায় আবছাবিস্ময়ভরে সেদিন দেখেছিলাম সবাই কেমন ওই পালঙ্ককে স্পর্শ করে, ওই ছবিকে প্রণাম জানিয়ে, নীরবে সারিবদ্ধভাবে হেঁটে নেমে আসছিল নিচে। দূর থেকে মৃদু স্বরে ভেসে আসছিল গান- ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে, যতদূরে আমি ধাই, কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই’ মৃত্যুর বোধ তখনো হয়নি কিন্তু তারপর থেকে কারও প্রয়াণসংবাদে স্কুলে যখন নীরবতা পালন করা হত, আমার চোখের সামনে ভাসত জোড়াসাঁকোর সেই ঘর, সেই পেতলের পুণ্য কলস, সাদা ফুলের রাশি, সেই সারি সারি মানুষের যুথবদ্ধ নীরবতা, শোকের স্তব্ধতা 

তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে…

স্কুলের পর্ব প্রায় শেষের মুখে। প্রেমের উদ্ভিন্ন কুঁড়ি ফুটতে শুরু করেছে। মনে কার নিত্য আসা যাওয়া! মনমোর মেঘের সঙ্গী, উড়ে চলে দিক দিগন্তের পানে, নিঃসীম শূণ্যে। শ্রাবণবর্ষণসঙ্গীতে মেঘমল্লারে সারা দিনমান বাজে ঝরনার গান বাজে ঝরনার গান। মন হারাবার আজি বেলা। পথ ভুলিবার খেলা। কখনও কখনও শ্রাবনের গগনের গায়, বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়। শ্রাবণবেলায় ছাদে উঠে ভিজতে থাকি। ভিতরটা কদম ফুলের মতো রোমাঞ্চিত হতে থাকে। ফুলদানিতে সাজাই বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। পরের দিনই দেখি কদমের ডাল থেকে সব ফুলের পাঁপড়ি গিয়েছে ঝরে। ছিন্ন কদম রয়েছে পড়ে অঙ্কুশ উঁচিয়ে। মনে পড়ে যায়, তুমিই তো বলে গিয়েছিলে ‘আজ এনে দিলে হয়তো দিবে না কাল। রিক্ত হবে যে তোমার ফুলের ডাল।’। তুমিই তো শিখিয়েছিলে, প্রেম আসলে ফুল ফোটানোর খেলায় যেন ফুল ঝরানোর ছল। রিক্ততাই প্রেমের সজীবতার শর্ত। অপ্রাপ্তিতেই তার সম্পূর্ণতা। বিরহতেই তার অমরত্ব।এটাই প্রেমের অমোঘ সত্য। তবুও অপ্রতিরোধ্য প্রেমের আকর্ষণ।

বৈষ্ণব পদাবলীর সেই রাধা-কৃষ্ণের কথা মনে আছে? চির বিরহিনী রাধা জানত, দয়িতের সঙ্গে তার চিরমিলন ঘটবে না। তবুও যখন ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশিথ যামিনী রে, তখন সে যেতে চায় কুঞ্জপথে।’ তুমি যতই ভানুসিংহ হয়ে তাকে বারণ করো, যতই বলো ‘গহন নয়নমে না যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ, /গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস।’ 

কিন্তু প্রেম যে অশঙ্ক, দুঃসাহসীপ্রেমের জন্যই তো ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।’ তাই শ্রাবনবেলায় হৃদি ভেসে যায়। থৈ থৈ করে মনের দালানকোঠা। আকাশভরা বেদনার রোদন সমুদ্রে ভাঙা তরী ধরে ভেসে যাই।

ভাঙা প্রেম নিয়ে এমনই এক বাইশে শ্রাবণে শুনতে গেলাম শিশির মঞ্চে, মোহন সিং খাঙ্গুরা। বদ্ধ প্রেক্ষাগৃহে চোখ বন্ধ করে শুনছি—‘সঘন গহন রাত্রি ঝরিছে শ্রাবনধারা। অন্ধ বিভাবরী সঙ্গ পরশহারা। মায়ালোক হতে ছায়া তরণী ভাসায় স্বপ্ন পারাবারে, নাহি তার কিনারা’ব্যাগেশ্রী মোচড় দিয়ে উঠছে। ভেসে যাচ্ছি। ভেঙে যাচ্ছে পাল। ভেসে যাচ্ছে তরণী। সেই গানের মতোই শ্রাবণে শ্রাবণে আজও বিস্মৃতি স্রোতের প্লাবনে ফিরে ফিরে আসিছে তরণী, বহি তব সম্মান।আজও ভাঙা প্রেম বেঁচে রয়েছে স্মৃতি-বিস্মৃতি পেরিয়ে। আজও তোমার আমার বিরহের অন্তরালে সেতু বেঁধে চলেছি। 

বিচ্ছেদের হোমবহ্নি হতে প্রেম…

শ্রাবন যে কত মানুষের জীবনে একাকী অশ্রুপাত, তা বুঝেছিলাম আমাদের পাড়ার শ্রাবনীদিকে দেখে। কোনদিন শ্রাবনীদিকে উজ্জ্বল রঙের শাড়ি পড়তে দেখে নি। কখন জোরে হাসতেও দেখোনি। উত্তর কলকাতায় ওদের স্যাঁতাপরা রোদ্দুর না ঢোকা বাড়িতে সব সময় যেন শ্রাবণ ছেয়ে থাকে। শ্রাবণীদি অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। মায়ের কাছে শুনেছিলাম পাড়ায় রবীন্দ্রনাথের কোনও অনুষ্ঠান মানেই শ্রাবনীদি আর অভিরূপদার গান। তার প্রস্তুতিতে শ্রাবনীদিদের বাড়িতেই রিহার্সাল লেগেই থাকতো। তারপর একাত্তরের উত্তাল সময়ে একদিন অভিরূপদা নাকি কোথাও নিখোঁজ হয়ে গেল। নিয়ে চলে গেল শ্রাবনীদির জীবনের সব রং। শুধু যেতে যেতে গানটি গেল ফেলে। ভাগ্যিস, তাই না এক শ্রাবন সকালে শুনলাম,  শ্রাবনীদির গলায় গান—‘বন্ধু রহো সাথে/আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে/ছিলে কি মোর স্বপনে সাথীহারা রাতে?/কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখ হাতে।’ হৃদয়েও কথা কওয়া যায়! সে কথা হয়তো অন্যেরা শুনতে পায় না। এমন অতিন্দ্রীয় একহারা প্রেমকে ক’জন লালন করতে পারে? ক’জন প্রেমকে এমন বিচ্ছেদের হোমবহ্নিতেও জ্বালিয়ে রাখতে পারে একা একা?রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া? তিনিই শিখিয়েছিলেন।

তাই তিনি আষাঢ় নয় শ্রাবণেই নিজেকে বারবার ভেঙেছেন গড়েছেন। শ্রাবণে ছায়ায় ঘোমটা পড়া ভোলাদিনের বিরহিণীকে চিনি চিনি মনে হয়। চোখে পিয়ার ছায়া ভাসে। মনে হয় বুঝি আসিছে সে।

সত্যিই শ্রাবণ মেঘের আধখোলা দুয়ারের আড়াল থেকে বুঝি উঁকি দেয় কেউ।বাদল আকাশে ওড়ে তার আবছা জানান দেয় সে আছে। শ্রাবণ যে অধরা। তবুও এমন কিছু মানুষ থাকে যাদের সঙ্গে আজীবন শ্রাবণ রয়ে যায় ভিজিয়ে দিতে, ভাসিয়ে দিতে।

বিষাদের অশ্রুজলে, নীরবের মর্মতলে…

যেমন ছিল ছোটকার সঙ্গে কৃতী ইঞ্জিনিয়ার ছোটকা চমৎকার সেতার বাজাতেন। রাগরাগিনীর যেটুকু পরিচয় আমার হয়েছে, তা ওই ছোটকার দৌলতে। রাত জেগে ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স শুনতে যাওয়া ছোটকার দৌলতে মল্লার উৎসবে যাওয়ার জন্য মায়ের কাছ থেকে অনুমতি মিলতই না ছোটকা না থাকলে। সত্যি বলতে কী মার্গ সঙ্গীতে আমার জ্ঞান তেমন ছিল না। শিখিওনি কোনওদিন শুধু কান তৈরি ছোটকার রেওযাজ শুনে শুনেসেবার একটা বর্ষার জলসায় রাগ মেঘমল্লার বাজাচ্ছিলেন শাহিদ পারভেজ। 

কিন্তু আমার কানে বাজতে লাগলো রবীন্দ্রসঙ্গীত—‘শ্রাবনের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়।’ 

পরে ছোটকা বলল, ঠিকই ধরেছিসরবীন্দ্রনাথের ওই গানে মল্লারের ছায়া আছে। ছোটকাকে অবশ্য রবীন্দ্রসংগীত গাইতে বড়ো একটা শুনিনি। কিন্তু জানতো অনেক কিছু। ছোটকার কাছেই শুনেছিলাম গল্পটা।  

সেবার শান্তিনিকেতনে বর্ষা মঙ্গলের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। সংগীত ভবনের নতুন মাস্টারমশাই সুশীল কুমার ভঞ্জ চৌধুরীকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, এবার বর্ষামঙ্গলে, যন্ত্রে আমার গান না বাজিয়ে তোমার গত্ বাজাবে তুমিবর্ষার কোন একটা রাগের গত্ তৈরি কর।একবার রিহার্সালের পরে একটা বর্ষার রাগের গত্ কবিকে শুনিয়েছিলেন সুশীলকুমার। শোনামাত্র গতটা লিখে নিলেন ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট থেকে তুলে নেওয়া একটা ব্রাউন খামে। ক’দিন পরে ডাক পড়ল সুশীলকুমারের দেখলেন রবীন্দ্রনাথের হাতে সেদিনের সেই ব্রাউন খামটা। রবীন্দ্রনাথ বললেন, এই নাও তোমার গান।

সুশীলকুমার দেখলেন, দেশ মল্লারে লেখা একটি গান –‘এসো শ্যামল, সুন্দর।’ পরেরবার শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গলেও ডাক পড়ল সুশীল কুমারের সুশীলকুমারের গৌড়মল্লারের তৈরি হল নতুন গান—‘মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো ওই’ গানটি সেবার অবশ্য এক আশ্রমিকের পুত্র মারা যাওযায় শান্তিনিকেতনের বর্ষামঙ্গল স্থগিত হয়ে যায়এরপর একদিন কবি সুশীলকুমারকে ডেকে বললেন, পরে সময়মতো তোমার অন্য মল্লারের গতেও গান লিখে দেবকিন্তু সে ইচ্ছে আর পূর্ণ হয়নি কবির 

১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতনের শেষ বর্ষামঙ্গল কবি লিখলেন—‘এসো এসো শ্যামছায়া’ শ্রাবণ বোধহয় রবীন্দ্রনাথের জীবনে একাকী অশ্রুপাতবৃষ্টির বন্দীশেই তৈরি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের তান-তোড়া-তেহাই

মার্গ সঙ্গীতের অনুরাগী আমার ছোটকার জীবনেও বোধহয় তাই-ই ছিল কিন্তু হটাৎই বাড়িতে একটা অঘটন ঘটে গেল। ছোট কাকিমা মারণ রোগে চলে গেলেন অসময়ে। সেই দিন থেকে আর সেতারে হাত ছোঁয়ায় না ছোটকা। আর সেতারে আলাপে ঘনায় না মেঘ আর মীড়ের টানে মোচড় দেয় না জয়জয়ন্তী আর ঝালায় ঝরে না মিয়ামল্লার 

কিন্তু একদিন এক শ্রাবণবেলায় দেখি, বন্ধ ঘরে ছোটকা গাইছে—‘আমার যে দিন ভেসে গেছে চোখের জলে/ তারি ছায়া পড়েছে শ্রাবণ গগনতলে/ সো দিন যে রাগিনী থেমে গেছে অতল বিরহে নেমে/… তার ছিড়ে গেছে কবে  একদিন কোন্ হাহারবে,/ সুর হারায়ে গেল পলে পলে

ছোটকার গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত! গাইতে গাইতে গলাটা ভেঙে যাচ্ছে রুদ্ধ কান্নায় বিষাদের অশ্রুজল নদী হয়ে ভেসে যাচ্ছে ছোটকার ঘরে ভেজানো দরজাখানা আলতো করে ঠেলে আমি যে দৃশ্য দেখেছিলাম, সেই দৃশ্য আমার চোখে সারা জীবনের জন্য আঁকা হয়ে রইল প্রিয়জনের জন্য শোক শ্রাবনের বারিধারার মতো বিরামহারা হয়ে ঝরতে লাগল নীরবের মর্মতলে আমি রইলাম তার সাক্ষী হয়ে

হে বন্ধু বিদায়…

বৃষ্টিঝরা শ্রাবণ কবির জীবনেও ছিল এক শোক-অধ্যায়। কবি কি মৃত্যুর ডাক শুনতে পেয়েছিলেন শ্রাবণের অন্তিম শেষ প্রহরে এসে? তাই কি শেষ বেলায় এসে শ্রাবণের গহন মোহকে আর বুঝি উপেক্ষা করতে পারলেন না! তাই কি ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের ‘মৃত্যু’ কবিতায় কবি লিখলেন—‘মৃত্যু অজ্ঞাত মোর, আজি তার তরে ক্ষণে ক্ষণে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ভোরে, এত ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয়, মৃত্যুকে আমি ভালবাসিলাম নিশ্চয়’ নিশ্চয়ই ভালবেসেছিলেন না হলে কী করে লিখতেন – ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যামসমান’ অবশেষে তাঁর সেই কাঙ্খিত ‘মরণ’ এল। য়ার আকুল আহ্বান না শুনলে তিনি কেন লিখেছিলেন – যায় দিন, শ্রাবণ দিন যায়,/আঁধারিল মন মোর আশঙ্কায়/আসন্ন নির্জন রাতি,/ হায় মোর পথচাওয়া বাতি/ ব্যাকুলিছে – শূণ্যের কোন প্রশ্নে?’ এই কি তাঁর লিখে যাওয়া এপিটাফ? আসন্ন মৃত্যুর সংকেত? তা কি আমরা ধরতে পেরেছিলাম? কবি জয় গোস্বামী লিখলেন – এক বিকেলে দুঃখ আসে, এক বিকেলে আলো/বৃষ্টি এসে ঢাকে কেয়াবন।/তোমার কি মেঘ দেখেও মনে পড়ল না/আজ ছিল বাইশে শ্রাবণ?’ সত্যি মেঘই সেই সংকেত পেয়েছিল। তাই এক বাইশে শ্রাবণে কবির বিদায়ের দিনে – বিকেলের রবি পড়িয়াছে ঢলে/অস্ত সাগর কোলে/শ্রাবণের মেঘ ভেসে আসে দলে দলে। রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে কাজী নজরুলের রচিত শোকগাথায় আমরা বিদায় জানালাম কবিকে।বললাম হে বন্ধু বিদায়।

বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে …

সেই থেকে শ্রাবণের মেঘের ভিতর চিরকালের শিলালিপি হয়ে রইল বাইশে শ্রাবণের শোক।কিন্তু শোকও কি কখনও অঙ্গার হয়ে যায়?–বিদ্রোহের আগুনে? যায় বোধহয়। রবীন্দ্রনাথই তো বলেছিলেন—‘এই শ্রাবণের বুকের উপর আগুন আছে।’ সত্যিই যে এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে সে কথা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম সেদিন। যেদিন এই শহরে এক স্বপ্ন দেখা তরুণীর মৃত্যু হল ঘাতকের আঘাতে। হিংস্র শ্বাপদের দল ছিঁড়েখুঁড়ে দিল তার নরম শরীরটাকে। তার চোখ থেকে জল নয় রক্ত ফুটে বেরিয়ে জমাট বাঁধল। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে মৃত্যু হল তিলোত্তমার এক ‘অভয়া’র।

তারপর সেই অভয়ার জন্য মোমবাতি হাতে পথ হাঁটল গোটা রাজ্য, গোটা দেশ, দেশ পেরিয়ে বিদেশ। মিছিলে মোমবাতির গায়ে মোমের মতো গড়িয়ে পড়ল বৃষ্টির জলের ফোঁটা। বারিবিন্দুতে প়ড়া আলো সহস্র প্রতিফলনে প্রতিবিম্বিত হতে থাকলে সকলের হৃদয়ে।অভয়ার চিতার আগুন থেকে আমরা জ্বালিয়ে প্রতিবাদের মশাল। দাবি উঠল বিচার চাই। শ্রাবণের ভিজে বাতাসে তা প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। শ্রাবণ ফুরিয়েছে। তবু আলো হাতে আর আগুন বুকে নিয়ে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।শ্রাবণের বৃষ্টির সুর ভেদ করে উঠছে প্রতিবাদের স্বর।

এমন করেই শ্রাবণ ঝরে চলবে আজীবন। জেগে থাকবে জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্র প্রয়াণকক্ষের নৈঃশ্বব্দের বিস্ময়ে। তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে। সাথীহারা ছোটকার বিষাদের অশ্রুজলে। শ্রাবণীদি আর অভিরূপদার বিচ্ছেদের হোমশিখায়।বাইশে শ্রাবণে বিদায়ের বরণডালায়। বিদ্রোহের আগুনের পরশমণি ছুঁয়ে।জল আর আগুনের সহাবস্থানে অনন্য হয়ে উঠবে শ্রাবণ।